শিল্পায়ন ও জীবিকা, সৈকত রক্ষিতের ‘আকরিক’ (১৯৮৪ খ্রি.) উপন্যাসের প্রেক্ষিতে
প্রত্যন্ত পুরুলিয়ার সমস্যা ও সংকটবহুল জনজীবনের মর্মন্তুদ কাহিনি শুনিয়েছেন কথা সাহিত্যিক সৈকত রক্ষিত (জন্ম : ১৯৫৪ খ্রি:)। হয়তো সামগ্রিকতার দিক দিয়ে পুরুলিয়ার কথা সৈকত রক্ষিতের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে কেউ লেখেননি। তিনি পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র। আধুনিকতার স্পর্শ-বঞ্চিত পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ভবঘুরের মত ঘুরতে ঘুরতে তাঁর লেখক হবার স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়। লিখতে শুরু করেন গল্প-উপন্যাস, যা স্বাদে-গন্ধে অন্যরকম। বাংলা সাহিত্যে অদ্যাবধি সৈকত রক্ষিত গ্রামবাংলার নিম্নজীবী মানুষের কথা লিখেছেন, লিখছেন, যা তাঁকে ‘প্লাসওয়ান’1–এ পরিণত করেছে, আলাদাভাবে চিনিয়েছে। সাতের দশক থেকে বাংলা সাহিত্যে যে বাঁকের সূচনা, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নবর্গ বয়ানের অনিবার্যতা; কথাকার সেই পথেই অগ্রসর হয়েছেন। লেখক তাঁর লেখা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন,
‘আমার লক্ষ্যই হলো সাব-অল্টার্নদের নিয়ে লেখালেখি। এই সীমিত জনগোষ্ঠী ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ধারা এবং বাঁচার দুর্মর প্রয়াসকে বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসা।’2
–স্পষ্টতই লেখক তাঁর লেখার উদ্দেশ্যমূলকতার জানান দিয়ে দেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে রচনা করেন ‘ডকুমেন্টেশন’—স্বচক্ষে দেখা জনজীবনের সমস্যা-সংকটের নিদারুণ ছবি।
পুরুলিয়ার জনজীবনের কথা লিখতে গিয়ে লেখককে সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার সংকটের কথা বলতে হয়েছে। অগণিত দারিদ্র্যপীড়িত, অশিক্ষিত মানুষদের বেঁচে থাকার লড়াই সৈকত রক্ষিতের সাহিত্যে সগর্বে উপস্থাপিত। সাতের-আটের দশকের জমি-অর্থনীতি, পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় দুর্নীতির কালোছায়া, সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়নে পরিকল্পনার অভাব –সমস্তকিছুই গ্রামীণ মানুষগুলিকে কঠিন লড়াইয়ে সামিল করেছিল। লেখকের রচিত প্রথম উপন্যাস ‘আকরিক’ (১৯৮৪ খ্রি.) তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
‘আমার লেখালেখির জীবনের শুরুতেই লক্ষ্য ছিল এখানকার [পুরুলিয়া] ভাষা-সংস্কৃতিকে বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত করা। ‘আকরিক’ থেকেই সেই প্রয়াসের শুরু। সেই সঙ্গে আমার ভাবনা এটাও ছিল যে, আমার পটভূমি, বিষয়বস্তু, উপাদান এবং চরিত্ররা এমন হবে যা ইতিপূর্বে লেখা হয়নি।’3
–অর্থাৎ লেখকের প্রথম উপন্যাস থেকেই তিনি নতুন পথের পথিক, ‘প্লাসওয়ানে’র যাত্রী। পুরুলিয়া হলো বাংলার প্রত্যন্ত একটি জেলা। এই জেলার প্রত্যন্ত কয়েকটি পঞ্চায়েতের সংকটপূর্ণ জীবনের কথা রয়েছে ‘আকরিক’ উপন্যাসে। শিল্পায়নের প্রসারে জীবন ও জীবিকা কিভাবে সমস্যা জর্জরিত হতে পারে তার চিত্র উপন্যাসটিতে পরিস্ফুটিত। একসময় ব্রজপুর-হেঁসাহাতু-কলমা অঞ্চলের মাঝি-মুড়া-দিগার-লাপিত-সাউ-মাহাত প্রভৃতি মেহনতি মানুষের সামনে কাজ নিয়ে উপস্থিত হয় ঠিকাদার। কারণ হেঁসাহাতু অঞ্চলে চুনাপাথরের খাদান পাওয়া গেছে এবং ঠিকাদারবাবু সেই খাদান থেকে চুনাপাথর শহরে নিয়ে যাবেন।

‘কাতর মানুষগুলো একদিন অবাক হয়ে গেল ! তাদের ক্ষুধার রাজ্যে এসে ঢুকলো শহরের মোটর গাড়ি। ট্যারাক।’4 –‘আকরিক’ উপন্যাসের মূল কাহিনি শুরু হয়েছে এখান থেকেই। মোটর গাড়ি তো এমনি আসেনি, এসেছে ‘লিত্ ভখাদের’ কাছে ‘কাম’ নিয়ে। মাঝি-মুড়া-দিগার-লাপিত-সাউ-মাহাতরা দীর্ঘদিনের অলস-বেকার জীবনের মাঝে কাজের সন্ধান পেয়ে যায়, সাময়িকভাবে আশ্বস্ত হয় এইভেবে যে তাদের আর অনাহারে জীবন কাটাতে হবে না। হেঁসাহাতু-কলমা প্রভৃতি অঞ্চল জুড়ে নানারকমের আকরিকের খাদান রয়েছে। আকরিক সমৃদ্ধ অঞ্চলে সরকারি প্রকল্প বাস্তাবায়িত হওয়ার আগেই বেসরকারি কোম্পানি এই আকরিক উত্তোলনে অগ্রসর হয়। ঠিকাদারবাবুর আগ্রহে এই অঞ্চলের মানুষেরা পাথর কাটার কাজ পায়। মজুরি সামান্য কিন্তু ‘কামিয়া লক ইয়াতেই খুশ।’
পাথরের খাদানে কামিয়া লোকেদের পাশাপাশি পূর্বদিকের কলমা অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের কথাও উঠে এসেছে। যখন সরকার কলমা-মাহাতমারা অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তখন এখানকার জমির উপর নির্ভরশীল মানুষের জীবনেও আতঙ্কের ছায়া পড়ে। বাঁধ প্রকল্পের বাস্তবায়নে বহু জমি অধিগ্রহণ জরুরি, অথচ এই জমিতে শত মানুষের জীবনযাপন জড়িত।
আকরিকের খাদানের কাজ সেখানকার জনজীবনকে সচল রেখেছে। সামান্য কিছু মজুরির জন্যে তাদের কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, ‘কাম করতে হবেকই। কাম না করলে পেটের আগুন জুড়াবেক কিসে? তার উপর আদ্যাভখা না হলে কেউ এই যমের খাদানে কাজ করতে আসে !’5 প্রতিনিয়ত এদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ অথচ সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উপন্যাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রকল্পের প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু বলাই বাহুল্য উভয়ই অভিশাপ হিসেবে বর্ষিত হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে। প্রথমে কলমা অঞ্চলে ড্যাম তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সমগ্র হেঁসাহাতু-কলমা অঞ্চলের আকরিকের উপর নির্ভর করে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। লক্ষ করলে দেখা যাবে উভয়ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে চাষের জমি এমনকি বাসভূমিও। শিল্পায়নে জমি অধিগ্রহণ আইনসঙ্গত কিন্তু অপরিকল্পিত জমি অধিগ্রহণে জমির স্বত্বাধিকারীদের জীবন কতখানি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তার পরিচয় পাওয়া যাবে এই উপন্যাস পাঠে।
ব্রজপুর-হেঁসাহাতু-কলমা অঞ্চলের জনজীবনে যেভাবে জীবন-জীবিকার সংকট দেখা দিয়েছে তার কয়েকটি স্তর চিহ্নিত করা যায়—
[ক] চুনাপাথরের খাদানে কাজ পাওয়ার মধ্যে দিয়ে চাষি থেকে সস্তার মজুরে পরিণত হওয়া ;
[খ] জমিতে ‘গাড়হা’ করার চুক্তিতে ঠিকাদারের প্রতারণায় জমির স্বত্ত্ব হারানো ;
[গ] বাঁধ তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ, চাষের জমি হারানো ;
[ঘ] সিমেন্ট ফ্যাক্টরি তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ, সর্বোপরি পাথরের খাদানের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
লক্ষণীয় সর্বক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত তথা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে এই অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। উপন্যাসের সীমিত পরিসরে টুকরো টুকরো বয়ানের মধ্যে দিয়ে কথাকার বিভিন্ন জীবিকার কথা তুলে ধরেছেন। রুক্ষ অনুর্বর মালভূমি অধ্যুষিত অঞ্চলে কিভাবে জনজীবন সচল থাকে তার আভাস পাওয়া যায়। যাদের চাষের জমি আছে তারা চাষ-আবাদ করে, না থাকলে পাথরের খাদানে পাথর ভাঙার কাজ। ঘানা-ছেনি নিয়ে দুইজনের দল পাথর ভাঙ্গে। এক ‘খড়মা’ পাথর ভাঙলে চার টাকা; ২৫ ঘনফুট (Cft.) অর্থাৎ প্রায় এক টন ওজনের চুনাপাথরের ব্লক হলো এক ‘খড়মা’। সারাদিনের চরম খাটুনিতে এরা প্রত্যেকে তিন টাকার বেশি আয় করতে পারে না। কিন্তু এই সামান্য কটা টাকা এইসব মেহনতি মানুষের কাছে সামান্য নয়, ‘হঁ, এক টাকা ত এক টাকাই। শালা, সের দু’সের চাল ত হবেক। নকি বল ?’ শীতের মরশুমে কলমা অঞ্চলের চাষিরা কঠোর শ্রমে গমের আবাদ করে, কিন্তু হেঁসাহাতুর লোক তখন কুসুম কাঠ কুঁদে হাল বানায়, দুদিনের মেহনতে দুটো হালের বিনিময়ে পাঁচ টাকা রোজগার করে। সাঁওতাল কুলহি’র বউ-ছেলেমেয়েরা বসে থাকে না, পাহাড়ি বন থেকে কেন্দু পাতা (বিড়ি তৈরির পাতা) কুড়িয়ে আনে, পনেরো পয়সা শ’-এর হিসেবে পাতামালিকদের কাছে বিক্রি করে।

চুনাপাথরের টিলায় পাথর ভাঙার কাজে পেট চলে ঠিকই কিন্তু সে কাজ কঠোর পরিশ্রমের। খাদানের কাজ বন্ধ হলে আবার উপবাসে থাকা। রুক্ষ জমিতে জলের অভাবে ফসল ফলানো যায় না, সেই সমস্যার সরকার বাঁধ তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করলো। জমি অধিগ্রহণে জমির দখলদারিদের ‘লীট দাবি’ জানাতে বলা হলো। কিন্তু বাস্তবিক সরকারি উদাসীনতা ও সঠিক পরিদর্শনের অভাবে সাধারণ মানুষদের যে কতখানি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তার দৃষ্টান্ত রয়েছে এই উপন্যাসে,
‘…যদি গরমেন্টি ক্ষেত-ডুবাদের একটা মটাসটা কিছু ব্যবস্থা করত—অন্য জায়গায় জমিদারের বেনামী জমি খাস করে বোদোল দিত, তাহলে বলা চলত…কিন্তুক গরমেন্টি ক্ষেত-ডুবাদের নিয়ে রা কাড়ছে নাই। খালি বলছে ‘লীট দাবি’ জানাও।’6
‘শুধু কলমা অঞ্চল জল পাবেক আর হেঁসাহাতু পাবেক নাই ক্যানে ?’7
‘তুমি গরমেন্টি। পাব্লিকের কাম করার তুমি এক্তিয়ার। তা বলে, পাব্লিক বাঁচল কি মরল—ই খোবোর লিবে নাই ?’8
‘…তুমি মানুষ খেদে গাঁয়ে গাড়্হা করবে—ই মানুষগুলা যাবেক কথায় ? তুমি পহিলে ইয়াদের ব্যবস্থা কর। তা বাদে গাড়্হা। তা-ও যদি করতে হয় সুবন্ন র্যাখায় [সুবর্ণরেখা] বাঁধ দাও। গরমেন্টি আমাদে স্যা প্রস্তাব লাকচ্ করে দিয়েছে।’9
খনিজ সমৃদ্ধ পাহাড়ি এলাকায় প্রাইভেট কোম্পানির ঠিকাদার জমি থেকে ‘চায়না ক্লে’ সগ্রহে জমির মালিকদের টোপ হিসেবে দেয় নামমাত্র মজুরির কাজ আর জমিতে ‘গাড়্হা’ জরিমানা দিয়ে জমিগুলো কোম্পানির নামে লিখে নেওয়া। যদিও সরকারি হস্তক্ষেপে কোম্পানি জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কিন্তু এদিকে ‘জমিও ফাচোট্, কামও ফাচোট্।’ তখন শিবু গোঁসাই হাটে গেয়ে বেড়ায়—
আমার ক্ষ্যাত গেল ডব্হা হল
গরু-হালে কী হবেক?
যমের গাড়্হায় সনা তুপা
ডব্হা লিয়ে কী হবেক?’10
কলমা অঞ্চলে জলের অভাব মেটাতে একসময় সরকার ড্যাম তৈরির কথা ঘোষণা করে। মাইলের বেশি জমি নিয়ে তৈরি হবে কাঁড়িয়র ড্যাম, ডিমু ড্যাম। বাঁধ তৈরি হলে কলমা অঞ্চলে জলের অভাব মিটবে সন্দেহ নেই কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারি নীতির (১৮৯৪ সালে গৃহীত জমি অধিগ্রহণ নীতি যা ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়েছে) গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ঝালদা অঞ্চলে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি হবে, ‘বাবুদের বিলডিন হবেক টৌনে। আর হেঁসাহাতু-কলমায় ? খেদ [তাড়াও] সব লিত ভখাদের । ঠিকাদার ত বলে গেছে, ভখে মরবি।’—কী চরম সত্য ! এক লপ্তে অর্ধভুক্ত কর্মঠ মানুষদের দীর্ঘশ্বাস যেন পাঠক শুনতে পান।
[ঘ] স্বল্প পরিসরের উপন্যাসটিতে প্রান্তিক বর্গের জীবন-জীবিকার কথাই শুধু নয়, স্পষ্ট প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করবেন, উপন্যাসের কাহিনি যত অগ্রসর হয়েছে প্রতিবাদের সুর তত ঘনীভূত হয়েছে। উপন্যাসের সমাপ্তিও প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে—
‘পরের দিন সাত হাজার কামিয়া। বুড়্হা-বুড়ি ছেলা-মেঞা। হাতে ঝাণ্ডা। ফতাঙ্গা। গাঁইট-কদাল-টাঙী-বল্লম-কাঁড়ধনুক! বর্জপুর থেকে মাহাতমারা হয়ে চৈল্য। ইনক্লাপ জিন্দাবাদ!’11
১৯৭৩ সালের ‘পঞ্চায়েত আইন’ অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়। পশ্চিমবঙ্গে এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ভাবে জয়ী হয় সরকার পক্ষ অর্থাৎ সিপিআই(এম) দল। এর আগের বছর (১৯৭৭ খ্রি.) বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়ে আসে বামফ্রন্ট দল। এই সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার একগুচ্ছ প্রকল্প গ্রহণ করে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বর্গাদার আইন’ (১৯৫০ খ্রি.) বাস্তবায়নের জন্যে ‘অপারেশন বর্গা’ কর্মসূচি গ্রহণ করা। এর লক্ষ্য ছিল ভাগচাষি ও ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের জমির স্বত্ব দেওয়া। কিন্তু আইন নিশ্ছিদ্র ছিল না ফলে যা হবার তাই হল। অনেকক্ষেত্রেই বঞ্চিতরা ভাগচাষের অধিকার হারালো, ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে লাগলো। উপন্যাসে দেখি, রামভজন সাউ-এর জমির ভাগচাষি আদিম আনসারীকে তার স্বত্ত্ব থেকে বঞ্চিত করার সর্বত প্রচেষ্টা রামভজন করতে বাকি রাখেনি। বিভিন্ন উপায়ে এই অনিয়ম চলতে লাগলো—বন্ধকী জমি কোবালার সুযোগে নিজ নামে লিখিয়ে নেওয়া, হাল রসিত না থাকলে দখলি জমিও জমিদারের খতিয়ানে যুক্ত হওয়া, জমি বেদখল করে প্রথমে বেনামি পরে জমি আত্মসাৎ, সেটেলমেন্টে প্রজার জমি কম করে দেখানো ইত্যাদি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নতুন পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামগুলির শ্রীবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে গ্রামগুলিতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষ বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ পাচ্ছিল। কিন্তু সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে তা নগণ্য বললেই চলে। পঞ্চায়েতে দুর্নীতি খুব শীঘ্রই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন প্রকল্প অসমাপ্ত থাকলেও কাগজে-কলমে সমাপ্ত দেখান হল, ‘…পুন্না বাঁধ লতুন করে কুঁড়ার রিলিপের কাম ছিল। ৮০ কুন্টালের আলটম্যান। স্যা কাম চৈখেও দেখা গেল নাই। পঞ্চায়েতের খাতা-কলমেই বাঁধ কুঁড়া হয়ে গেল।’12 পঞ্চায়েত সদস্যরাও ক্রমশ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লো। এর থেকে নিস্তারের উপায়ও লেখক উপন্যাসে দেখালেন, প্রতিবাদের মাধ্যমে নিজেদের দাবি জানাতে হবে। কিঙ্কর দত্ত হলো সেই প্রতিবাদের মুখ। সমগ্র উপন্যাসে এই ‘একজন’ কামিয়া-ভাগচাষিদের হয়ে কাজ করেছে। পঞ্চায়েতের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চিঠি লিখে, পিটিশন দিয়ে বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, ‘..সোব কামে ‘য়ুনিয়ন’ কর। কিষাণরা কর চাষ কাজের য়ুনিয়ন, কামিয়া লকরা কর খাদানের য়ুনিয়ন। না হলে গাঁয়ে টেকতে লারবে।’13 সমগ্র উপন্যাসটিতে আলোচিত এই দুটি ভাব কেন্দ্রীভূত হয়েছে, একদিকে প্রান্তবর্গের মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা অন্যদিকে তাদের মধ্যে প্রতিবাদী সত্ত্বার জাগরণ। এই কারণে এই উপন্যাস শুধু সমস্যা-সংকটের কথা জানায় না, সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কথাও বলে। তাই শেষপর্যন্ত এই উপন্যাস প্রতিবাদের গল্প হয়ে ওঠে।
আলোচিত উপন্যাসের পরিচিতি :
উপন্যাস - আকরিক লেখক - সৈকত রক্ষিত প্রথম প্রকাশ - সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ প্রকাশক - শিল্প সাহিত্য, কলকাতা মুদ্রিত মূল্য - ৮ টাকা মোট পৃ. - ৯৫
সূত্রনির্দেশ
- দ্র. সৈকত রক্ষিতের ‘প্লাসওয়ান’, কোরক, প্রাক্শারদ সংখ্যা, ১৪১৫।
- সৈকত রক্ষিত, প্লাসওয়ান, কথাসাহিত্যে সৈকত রক্ষিত (সম্পা. অরূপ পলমল), ডাভ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ২০১৩। পৃ. ২৮
- তদেব।
- সৈকত রক্ষিত, আকরিক, শিল্প সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৮৪। পৃ. ১৬
- ঐ। পৃ. ২৬
- ঐ। পৃ. ৭৬
- তদেব।
- তদেব।
- ঐ। পৃ. ৯৪
- ঐ। পৃ. ২৫
- ঐ। পৃ. ৯৫
- ঐ। পৃ. ৪৫
- ঐ। পৃ. ৫৬