অনিল ঘড়াইয়ের ‘নুনবাড়ি’, পেশাগত সংকট ও এক নারীর বেঁচে থাকার লড়াই

অনিল ঘড়াইয়ের 'নুনবাড়ি'

অনিল ঘড়াইয়ের ‘নুনবাড়ি’ : পেশাগত সংকট ও এক নারীর বেঁচে থাকার লড়াই


অনিল ঘড়াইয়ের 'নুনবাড়ি'
অনিল ঘড়াইয়ের ‘নুনবাড়ি’

এক

‘….গ্রামজীবনকে নিয়ে এত নিবিষ্টভাবে এত অনুপুঙ্খ সহকারে আমাদের মধ্যে আর কেউই বুঝি লেখেননি। গ্রামজীবন এমন অতলান্ত অবগাহন আর কারোর কলমেই আসেনি।’1

অনিল ঘড়াই সম্বন্ধে এমন মন্তব্য সমকালের একজন বরিষ্ঠ কথাকার ভগীরথ মিশ্র’র। সাহিত্যিকের উক্ত মন্তব্যসূত্রে বলা যায়, প্রান্তেবাসী মানুষজনদের নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখছেন আরেক প্রান্তেবাসী—অনিল ঘড়াই (জন্ম—১৯৫৭ খ্রি.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মেদিনীপুর জেলার এগরা থানার অন্তর্গত রুক্মিণীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন এই প্রখর বাস্তববাদী লেখক। শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নদিয়া জেলার কালীগঞ্জে। স্বভাবতই এই দুই জেলার গ্রাম্য প্রতিবেশ তাঁর লেখায় মূর্ত হয়েছে। ছোটোগল্প লেখার মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্য-অঙ্গনে প্রবেশ। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৯ সালে, ‘নুনবাড়ি’। মেদিনীপুরের নুনমারা মালঙ্গী সম্প্রদায় ও তাদের জীবনসংগ্রামের কাহিনি আলোচ্য উপন্যাসে ভাষা পেয়েছে। ক্ষুদ্রকায় এই উপন্যাসে লেখক খালপারের মানুষদের সংগ্রামপূর্ণ জীবনকাহিনি প্রকাশে গভীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। লেখকের নিরাসক্ত লেখনিতে মূর্ত হয়েছে এক দৃঢ়চেতা নারীর কথা—লবঙ্গর কথা। সদর্থে এই উপন্যাস শুধু এক প্রান্তিক সমাজের কাহিনি নয়, এক প্রান্তিক নারীর সংগ্রামের কাহিনিও।

অনিল ঘড়াইয়ের লেখার মূল অবলম্বন গ্রামের প্রান্তিক মানুষজন। নিজস্ব অভিজ্ঞতার বলিষ্ঠ রেখাপাত তাঁর উপন্যাসগুলিতে লক্ষণীয়। প্রথম উপন্যাস ‘নুনবাড়ি’-তেই অনিল ঘড়াই পাঠককে বুঝিয়ে দেন, তিনি প্রচলিত পথের পথিক নন। তিনি যে জীবনবেদ রচনা করেন তা কল্পনাবিলাসী কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা নয় বরং বাস্তববোধে তা প্রতিভাসিত। সমালোচকের কথায়,

‘দূর থেকে কোনো এক মায়াবী কল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে অনিল ব্রাত্যজীবনের রুদ্ধসঙ্গীত রচনা করেননি, এঁদেরই একজন হয়ে নিম্নবিত্ত কিংবা বিত্তহীন অস্পৃশ্য অসহায় মানুষগুলির জীবনসংগ্রামের প্রতিটি খুঁটিনাটিকে তিনি উপস্থাপন করেছেন অনায়াস দক্ষতায়’।2

–জীবনসংগ্রামের প্রতিটি চড়াই-উৎরাই কথাকার আলোচ্য উপন্যাসে উপস্থাপিত করেছেন। এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য যে নুনমারা সম্প্রদায়, বাংলা সাহিত্যে তাদের পরিচয় অপরিজ্ঞাত ছিল। লেখক তুলে ধরেছেন তাদের জীবনসংগ্রামের কথা, বেঁচে থাকবার আপ্রাণ প্রচেষ্টাকে। লেখক স্বয়ং এই প্রান্তেবাসী সমাজের চরিত্র বোঝেন, তাদের লড়াইয়ের সঙ্গে তিনি পরিচিত। তাদের কথা লিখতে তাই লেখককে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি। এই প্রসঙ্গে লেখকের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়,

‘আমি সেইসব মানুষকেই আমার কলমে তুলে ধরার চেষ্টা করি, যারা সমাজে আরও নিচুতলার মানুষ হয়ে জন্মানোর অপরাধে অভিশপ্ত জীবন ভোগ করছেন। খরায় পোড়া মাঠে আজও যারা পঞ্চায়েতের দরজায় ঘুরে বেড়ায় রিলিফের জন্য, দুঃখ-দারিদ্র্য আজও যাদের নিত্য সঙ্গী, অথচ যারা আজও বিবেকী সৎ, মানবতার জয়গানে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পিছু হটে না—আমি তাদেরই গান গাই, ছবি আঁকি, গল্প শোনাই। গ্রামবাংলার রূপবৈচিত্র্য, জীবন-সংস্কৃতি, সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত মানুষের বেঁচে থাকার হুবহু ডকুমেন্টনেশনই আমার উদ্দিষ্ট’।3

অপিচ—

‘বিলাসিতার ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠিনি বলেই হয়তো আমার মনটা এখনও তাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই, তথাকথিত সফিস্টিকেটেড মানূষ যাদের বলা হয় তাদের নিয়ে এখনও লিখতে পারিনি, এটা আমার অক্ষমতা’।4

–লেখকের এই ‘হুবহু ডকুমেন্টেশনে’র মধ্যে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে দলিতদের জীবনাখ্যান, প্রান্তেবাসীদের যাপনচিত্র।

দুই

মেদিনীপুরের নুনমারা সম্প্রদায়ের মেয়ে লবঙ্গর বেঁচে থাকার লড়াই আলোচ্য ‘নুনবাড়ি’ (১৯৮৯ খ্রি.) উপন্যাসের বর্ণনীয় বিষয়। লবঙ্গ স্বামী পরিত্যক্তা, এক ছেলের জননী। ছেলে নোনাইকে সঙ্গে নিয়ে ‘চিকনি’ শাক তোলার নাম করে লবঙ্গ বাপের বাড়ি পালিয়ে এসেছে। লবঙ্গ বাধ্য হয়েছে পালিয়ে আসতে, কারণ তার স্বামী কালাচাঁদ গঞ্জের এক মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। তাছাড়া লবঙ্গর পিতা জটায়ু শর্তানুযায়ী বিবাহের যৌতুক-স্বরূপ একটি বাইক জামাইকে কিনে দিতে পারেনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই লবঙ্গ তার শ্বশুরবাড়িতে বোঝা হয়ে উঠেছিল। শাশুড়ি বলেছিল, ‘অমন অপয়া বউ আমি জন্মেও দেখিনি। যেদিন থেকে এ ঘরে পা দিন সেদিন থেকেই অশান্তি। তোর ব্যবসা গেল, জমি-জমা গেল, মাঝখান থেকে খেটে খুটে বুকে কালরোগ বাঁধিয়ে বসলি। ওরে তুই খেদা কেলো’।5 এরপর কালাচাঁদ গঞ্জের মেয়েটিকে বিয়ে করতে দেরি করেনি। পণপ্রথার বলি হয়ে লবঙ্গ বাঁচতে চেয়েছিল স্বাধীনভাবে, পালিয়ে এসেছিল পিতার কাছে, নোনাখালে। স্বধীনতার বহুবছর পরেও প্রান্তিক সমাজে পণপ্রথার শিকার হয়ে নিঃশেষিত হচ্ছে লবঙ্গর মতো নারীরা।

See also  কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখক জীবনের প্রেক্ষিত

পুরুষশাসিত সমাজে লবঙ্গের মতো অবহেলিত, বঞ্চিতা নারীর একা বেঁচে থাকার সংগ্রাম স্পর্ধা-স্বরূপ। যদিও পিতার কাছে লবঙ্গ পরগাছা হয়ে থাকতে চায়নি, সৎপথে পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জনের অর্থে বাঁচতে চেয়েছে। বাড়ির পাশে ‘খানাখন্দ’ লাগিয়ে, বাপের চায়ের দোকানে চা-বিক্রি করে, গোবর দিয়ে ঘষি তৈরির পর সেগুলি বিক্রি করে, মুড়ি ভেজে, চিঁড়ে কুটে, পোদ্দারবাবুর ধানকলে ধান ঝাড়াইয়ের কাজ করে লবঙ্গ তিনজনের খাবার জোগাড় করেছে। গাঁ-গ্রামে মেয়েদের কাজ পাওয়া দুস্কর, তাছাড়া অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিনজনের পেট চালানোও সম্ভব নয়। তাই নিদারুণ কষ্টে লবঙ্গ নুন তৈরি করতে চেয়েছে। নুন তৈরি করা খালপারের সমাজের পুরোনো বৃত্তি।

নুন তৈরি খুব পরিশ্রমের কাজ। নোনাখাল থেকে নুনমাটি সংগ্রহ করে নুনবাড়িতে জমিয়ে নুনজল সংগ্রহ করতে হয়। এরপর নুনজল ফুটিয়ে তৈরি হয় নুন। নুন-মহাজন পোদ্দারবাবু বা গঞ্জের মহাজনের কাছে সেই নুন বিক্রি করলে তবে পয়সা রোজগার। কিন্তু নুনজল থেকে নুন তৈরিতে রয়েছে মস্ত বিপদ—নুনসংগ্রহকারীরা ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হয়। মেয়ে লবঙ্গ নুনবাড়ি করতে চাইলে জটায়ু বলেছিল, “নুনবাড়ি যেন তোর মরণ-বাড়ি না হয়! নুনবাড়িতে ঘোঘা হলে সেই ঘোঘা বুকেও বাসা বাঁধে। আমার কেবল এই একটাই ভয়”।6 সমস্ত ভাবনা-দুশ্চিন্তাকে উপেক্ষা করে নুনবাড়ি করতে চেয়েছে লবঙ্গ। তার মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ী ভাবনা কাজ করেছে সর্বদা। অন্যের গলগ্রহ হয়ে না থেকে স্বাধীনভাবে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছে।

শীতের শেষে ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ—এই তিনমাস নুনমাটি থেকে নুন তৈরির মরশুম। লবঙ্গ ‘চর’ দাগিয়ে নুনমাটি সংগ্রহ করেছে, নুনবাড়ি তৈরি করে কলসিতে নুনজল সংগ্রহ করেছে। তারপর নুন তৈরি করে পোদ্দারবাবুর নুনকুঠীতে বেচেছে। কন্ঠিরামকে জীবনসঙ্গী করে আগামী জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়েছে। সমাজের অপবাদ-লোকনিন্দাকে তুচ্ছজ্ঞান করে লবঙ্গ-কণ্ঠীরামের স্বতন্ত্রভাবে বেঁচে থাকার অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে লেখক এই আখ্যানের ইতি টেনেছেন। আর পাঠকের উপলব্ধিতে প্রোথিত হয়েছে লাঞ্ছিতা এক রমনীর বেঁচে থাকার আপ্রাণ লড়াই।

আলোচনার শুরুতে নারীকে ‘প্রান্তিক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বাস্তবিক পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে পর-মুখাপেক্ষী হয়েই কাটাতে হয়। স্বতন্ত্র, স্ব-রোজগারী হয়ে বাঁচতে চাইলে প্রতি মুহূর্তে নারীকে হেনস্থা করা হয়। লবঙ্গও স্বতন্ত্র হয়ে নোনাইকে নিয়ে নোনাখালে জীবন অতিবাহিত করতে চেয়েছিল। পরিবর্তে তার জুটেছিল গঞ্জনা, এমনকি তার পিতাও তাকে ভুল বুঝে নোনাখালে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিকতায় নারীর জীবন-সংগ্রাম তাই নিষ্কণ্টক নয়। লবঙ্গর জীবনে সংকটের সূচনা হয়েছে তার স্বামীগৃহে। স্বামী কালাচাঁদ অন্য নারীতে আসক্ত—‘গঞ্জের হাটে সুন্দরী রাঁড় রেখেছে সে’। তাই লবঙ্গ নির্দ্বিধায় পতিগৃহ ত্যাগ করেছে, কন্ঠিরামের সন্তান গর্ভে ধারণ করে সমাজকে বার্তা দিতে চেয়েছে যে তারও বাঁচার স্বাধিকার রয়েছে,

‘জীবনটা বাঁধা পুকুরের জল নয়, নোনাখাল। …যে সমাজ দুবেলা দুমুঠো ভাত দিতে পারে না, সেই সমাজের এমন একপক্ষ নীতিজ্ঞান সে মানে না’।7

তিন

‘নুনবাড়ি’ উপন্যাসে প্রান্তেবাসী নুনমারা সম্প্রদায়ের জীবলালেখ্য বর্ণিত হয়েছে। নুন তৈরির খুঁটিনাটি বিষয় লেখক লবঙ্গর ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। নুন তৈরির বিভিন্ন স্তর-পর্যায় রয়েছে—মরশুমের মাসগুলোতে নোনাখালের দুইপারে জমে নুনমাটির পলি। সেই পলি অর্থাৎ নুনমাটি সংগ্রহের জন্যে প্রত্যেকে চরের নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করে। এরপর জোয়ার শেষে সেই পলিমাটি সংগ্রহ করতে হয় কোদাল, ছুচনি, ঝুড়ি দিয়ে। পরবর্তী ধাপে রয়েছে নুনবাড়ি তৈরি অর্থাৎ নুনমাটি রেখে নুনজল ধরবার জন্য বিশেষ পদ্ধতির মাটির খোপ। মাটিতে দুটি আলাদা মাপের গর্ত খুঁড়তে হবে—যার একটির মাপ অন্যটির দ্বিগুণ। এরপর একটি গর্তে নুনমাটি রেখে তুলনামূলক গভীর গর্তটিতে রাখতে হবে কলসি। আর এই দুই গর্তের মাঝে থাকবে তল্লা বাঁশের চোঙা—যার মধ্যে দিয়ে নুনজল টুপিয়ে পড়বে কলসিতে। পরবর্তী পর্যায়ে তৈরি হবে নুনবাণ অর্থাৎ নুনজল ফোটানোর বড়ো উনুন। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিশ্রমের পর পাওয়া যাবে নুন—যা দুর্মুল্য নয় অথচ অবশ্য প্রয়োজনীয়।

See also  SEZ ও একটি বাংলা উপন্যাস 'বন্দর', ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'বন্দর'

লবঙ্গর পিতা জটায়ুর বংশে কেউ কখনো নুন তৈরিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেনি। কিন্তু সময়ের পট-পরিবর্তনে জটায়ুর মেয়ে লবঙ্গ বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছে সেই নুন তৈরির পেশাটিকেই। জটায়ুর চায়ের দোকানের রোজগার সংসারের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য যথেষ্ট নয়। তাছাড়া প্রযুক্তির বিবর্তন নোনাখালকেও পালটে দিয়েছে। জটায়ুর চায়ের দোকানে এখন খদ্দের কম, কারণ পাশাপাশি আরো দুটি চায়ের দোকান হয়েছে। নোনাখালের হাটখোলায় “বাবুলালের চায়ের দোকানে টেপে দিনরাত হিন্দি গান বাজে। খবরের কাগজ রাখে সে। …ফলে, ওর দোকানে ভিড় সব চাইতে বেশি”।8 প্রযুক্তিগত কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হয়েছে জটায়ু, তাই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে নুনমাটি সংগ্রহ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। প্রকৃতপক্ষে শহুরে প্রযুক্তির নিত্য-আগ্রাসনে প্রত্যন্ত সমাজও আক্রান্ত হয়ে যায়। তাই বৃত্তিগত সংকটে জটায়ুরা ভিন্ন পেশা গ্রহণে বাধ্য হয়।

নুন তৈরির জটিল কৃৎকৌশলের পাশাপাশি নুন তৈরির হাজারো সমস্যা রয়েছে। নুনবাড়িতে ঘোঘা হলে বিপদ। তখন নুনজলের ঢল নামবে কলসিতে যা দিয়ে ভালো নুন তৈরি হবে না। ‘‘ঘোঘা’ই হলো নুনবাড়ির শত্রু।” এছাড়াও রয়েছে নুনের রঙের প্রসঙ্গ। নুনের কারবারি পোদ্দারবাবু বলেছে, “খেয়াল রাখিস নুন যেন কালো না হয়”—তখন লবঙ্গের দুশ্চিন্তা বাড়ে বই কমে না। প্রকৃতপক্ষে নুনের কারবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমবর্ধমান, এবং নুনমারারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নানা কৌশলও অবলম্বন করে। নুনের রঙ সাদা করার প্রসঙ্গে অবলা লবঙ্গকে বুদ্ধি দিয়েছে—“ফিটকিরি কিনে আন সাউদের দোকান থেকে। তারপর সেই ফিটকিরি ছিঁটে মার ফোটা নুনজলে”।9 লবঙ্গদের পুরোনো পদ্ধতিতে নুন তৈরির পাশাপাশি রয়েছে আধুনিক পদ্ধতিতে নুন তৈরির কৌশল। নুনের কারবারি পোদ্দারবাবুই আধুনিক পদ্ধতিতে নুন তৈরিতে সমর্থ। পোদ্দারবাবুর ‘বিঘার পর বিঘা জমি পাকা করে তার উপরে নুনের চাষ’। সিমেন্টের বাঁধানো চাতালে টিন ভরে জল ধরে রেখে, সেই জল রোদের তাপে শুকিয়ে নুন তৈরি হয়। কিন্তু পোদ্দারবাবুর চাতালের নুন হাতে তৈরি নুনের মতো স্বাদু নয়। নুনের কারবারী পোদ্দারবাবু বিচক্ষণ ব্যবসায়ী, তাই লবঙ্গদের অগ্রিম দাদন দিয়ে কম মূল্যে ভালো নুন কেনেন। বাস্তবিক লবঙ্গের মতো অন্য নুনমারারা অগ্রিম অর্থের কারণে পোদ্দারবাবুর কাছে নুন বেচতে বাধ্য হয়, এবং স্বাভাবিকভাবেই সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

 লবঙ্গ যাকে ভালোবেসেছে, যার সহযাত্রী হয়ে সমাজের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছে সেই কণ্ঠিরাম অন্নের সংস্থানে শুধুমাত্র নুন তৈরির উপর নির্ভরশীল না হয়ে যাত্রাদলে বাঁশি বাজিয়েছে। শীতের মরসুমে কন্ঠিরাম গ্রামেগঞ্জে যাত্রাদলের সঙ্গে ঘুরে বাঁশি বাজায়। কন্ঠিরাম বলেছে, “নুন ব্যবসায় আর আগের মতন সুখ নেই। এখনকার নুন খুব তাড়াতাড়ি গলে যায়”।10 প্রক্রিতপক্ষে নুনমারাদের পুরোনো, স্বাভাবিক পদ্ধতিতে তৈরি নুন বেশিদিন বস্তা বন্দী করে রাখা যায় না। স্বল্পমূল্যে বেচে দিতে হয়, ফলত আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কন্ঠিরাম-লবঙ্গরা। এছাড়াও নুনমাটির দখল নিয়ে হাভাতে মানুষদের নিত্য দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। চরদাগাতে গিয়ে লবঙ্গ অনুভব করেছে তার মতো অসহায় মানুষের সংখ্যা নগণ্য নয় নোনাখালে, যারা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হারতে চায় না। নুনমারাদের একজন হয়ে লবঙ্গর উপলব্ধি-ভাবনা সঞ্চারিত হয় পাঠকের মধ্যে; প্রান্তেবাসী-কর্মঠ মানুষের যাপিত জীবন ও তাদের বৃত্তিগত সংকট প্রত্যক্ষ হয় উজ্জ্বলতর রেখায়।

See also  শিল্পায়ন ও জীবিকা, সৈকত রক্ষিতের 'আকরিক' উপন্যাসের প্রেক্ষিতে

চার

সমগ্র উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে লবঙ্গ’র সংগ্রাম কাহিনি—স্বামী-সোহাগ বঞ্চিত এক নারীর জীবনের নানা টানাপোড়েন। লবঙ্গর সংগ্রাম শুধুমাত্র সমাজের বিরুদ্ধে নয়, নিজের আজন্মলালিত সংস্কারের বিরুদ্ধেও বটে। লবঙ্গ সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছে, অবলার মতো সে নিজেকে বিকিয়ে দেয়নি নিতাই সাঁতরাদের মতো নারীলোলুপদের কাছে। তার স্বাধীনভাবে বাঁচবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা, একসময় নিজের পিতাও লবঙ্গকে মারতে চেয়েছিল সমাজের দোহাই দিয়ে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও লবঙ্গ পরাজয় স্বীকার করেনি, তার মধ্যে পাঠক প্রত্যক্ষ করে বেঁচে থাকবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

প্রথাগত শিক্ষায় স্বল্পশিক্ষিত এক নারীর নিজের আজন্মলালিত সংস্কার ভেদ করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা খুব সহজ নয়—লবঙ্গর কাছেও তা সহজ ছিল না। স্বামী কালাচাঁদের উদাসীনতা ও প্রত্যাখানের পর লবঙ্গ নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চেয়েছিল বাঁশি-বাদক কণ্ঠিরামকে নিয়ে। কন্ঠিরামের সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ করতেও লবঙ্গ দ্বিধা করেনি। কিন্তু কন্ঠিরাম যখন গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করতে বলে তখন, লবঙ্গ ক্রুদ্ধ, দলিত কন্ঠে বলে, “আমি অবলা হব না কন্ঠিদা, তুমি যদি ভেবে থাক আমি অবলা তাহলে খুব ভুল হবে!”11 আবার বিবাহিতা, স্বামী-পরিত্যক্তা লবঙ্গ কন্ঠিরামের সঙ্গলাভে কোনোরূপ পাপবোধে জর্জরিত হয় না বরং সমাজের প্রতি প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দেয়—

‘পুরুষের দ্বিতীয় নারী তৃতীয় নারী এমনকী একাধিক নারী যখন কোনো নিন্দার নয়, তখন মেয়ে হয়ে দ্বিতীয় স্পর্শ, অন্য জীবন চাওয়াটা কি ভুল? এই প্রায় পুরুষ দলিত সমাজে পুরুষের পদস্খলন, স্বৈরাচার, অসংযম, স্বেচ্ছাচার, বিধংসী জীবনযাপন যদি নির্বিবাদে সকলে মেনে নেয় তাহলে একটা অসহায় আত্মসমস্যা জর্জরিত মেয়ের বেলায় তার ব্যতিক্রম হবে কেন?’12     

লবঙ্গর আত্মপ্রত্যয়ী বলিষ্ঠ কন্ঠের মধ্যে দিয়ে আখ্যানকার বঞ্চিতা, উপেক্ষিতা নারীর অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ শুধু কঠিন জীবনসংগ্রাম নয়, প্রেম সম্পর্কের কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছেন উপন্যাসের মূল চরিত্র লবঙ্গকে।

সমগ্র উপন্যাসের নিবিড়পাঠে উঠে আসে এক বঞ্চিতা নারীর বেঁচে থাকার লড়াই, এবং প্রসঙ্গক্রমে লেখকের অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা দেয়—নুনমারা মালঙ্গী সমাজের তীব্র জিজীবিষা ও তাদের জীবিকা সংকট। মালঙ্গীদের জীবিকার সংকটপূর্ণ অবস্থান থেকে তাদের মুক্তি ঘটবে কিভাবে কিংবা আদৌ ঘটবে কিনা—তার দিকনির্দেশ কথাকার না দিলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, লবঙ্গরা সমাজে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কখনো পরাজয় স্বীকার করবে না, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা-বঞ্চনা সহ্য করেও বেঁচে থাকার সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।


তথ্যসূত্র

  1. ভগীরথ মিশ্র, আমি ও আমার সময়ের গল্পকার বন্ধুরা, কোরক, শারদীয় ১৪১২। পৃ- ২১৯-২০ ↩︎
  2. শ্রাবণী পাল, অনিল ঘড়াইয়ের উপন্যাস : ‘ব্রাত্যজীবনের রুদ্ধসংগীত’, কোরক, প্রাক্‌ শারদ সংখ্যা ১৪১৫। পৃ- ২০২ ↩︎
  3. দ্রষ্টব্য: পূর্বোক্ত প্রবন্ধ। পৃ- ২০৫ ↩︎
  4. দ্রষ্টব্য: তদেব। ↩︎
  5. অনিল ঘড়াই, নুনবাড়ি, ২০১৬, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা। পৃ- ১৩ ↩︎
  6. ঐ। পৃ- ২৭ ↩︎
  7. ঐ। পৃ- ১২২ ↩︎
  8. ঐ। পৃ- ৬৭ ↩︎
  9. ঐ। পৃ- ৮১ ↩︎
  10. ঐ। পৃ- ৫৪ ↩︎
  11. ঐ। পৃ- ১২৫ ↩︎
  12. ঐ। পৃ- ১২৭-২৮ ↩︎

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *