সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্ম ১৯৩০ সালে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্যিক। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর রাঢ় বাংলার পটভূমি অনেক উপন্যাস-গল্প তিনি লিখেছেন। তাঁর লেখক জীবনের সূচনাপর্ব কীভাবে নির্মিত হয়েছিল, তার কিছু দিক সংক্ষেপে এখানে আলোচিত হলো।

কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ | লেখক জীবনের প্রেক্ষিত
একজন লেখকের সাহিত্য-কীর্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পূর্বে তাঁর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার প্রসঙ্গটি এসে পড়ে। লেখকের মানস-ভূমির প্রবণতার সঙ্গে পরিচিত থাকলে তাঁর সাহিত্য সমালোচনায় বেশ সুবিধা হয়। তাই প্রয়োজন পড়ে সংশ্লিষ্ট লেখকের প্রস্তুতিকাল বিশ্লেষণ। “একজন লেখকের দৃষ্টিভঙ্গী তথা লেখ্য বিষয় বাছাই, সেই সঙ্গে যাবতীয় প্রবণতার পিছনে যে পরিপ্রেক্ষিত থাকে, তা এই সব ঘটনার যোগফল। লেখ্য বিষয়ের বৃত্তে যে কেন্দ্র থাকে—তার নাম মানুষ। মানুষকে দেখার ধরণ-ধারণ নিয়েই যত পার্থক্য লেখকে-লেখকে।’’1 সিরাজ কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও কীভাবে গদ্যকার হয়ে উঠলেন, তার পারিপার্শ্বিকতা কতখানি তাঁর লেখায় উঠে এল এসবেরই ক্রম-উন্মোচনে সাহায্য করে তাঁর জীবনেতিহাসের প্রতিটি পাতা।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকের কথাকার। সমকালীন লেখক যথা, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের থেকে সিরাজ বরিষ্ঠ। আমরা দেখেছি শহরবাসী হওয়া সত্ত্বেও তিনি শহুরে জীবনকে উপেক্ষা করে একের পর এক লিখেছেন রাঢ়-মুর্শিদাবাদ অধ্যুষিত অঞ্চলের কাহিনি। সম্পাদকের আপত্তি সত্ত্বেও প্রান্তিক মানুষের কথাকেই সাহিত্যের আঙিনায় অগ্রাধিকার দিয়েছেন-
মনিদা [মনীন্দ্র রায়, অমৃত পত্রিকার সম্পাদক] বললেন, এবার গ্রাম-ফ্রাম ছাড়ুন। পাঠক নিচ্ছে না। আরবান জীবন আনুন, সেক্স ঢোকান। আমি রাজি হইনি।2
ক.
খোশবাসপুর, মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহাকুমার অন্তর্গত একটি গ্রাম। এখানকার একটি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও ধর্ম-নিরপেক্ষ পরিবারে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্ম (১৪ অক্টোবর, ১৯৩০ সাল)। এই পরিবারেই সিরাজ তাঁর সাহিত্য রচনার প্রাথমিক পাঠ নেন। অনুপ্রেরণাদায়ক দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য—প্রথমত, পারিবারিক আবহমন্ডল; দ্বিতীয়ত, পিতা-মাতার সাহিত্যপ্রীতি। বাবা সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী রাজনীতিক মানুষ হলেও তিনি সাহিত্যরসিক ছিলেন। সিরাজ নিজের স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন—“জন্মের পর চোখ খুলেই দেখেছি চারপাশে শুধু বই। আরবি ফারসি উর্দু প্রকান্ড সব বই।”3 বলাবাহুল্য সেইসঙ্গে কলকাতার নগর সংস্কৃতির সংমিশ্রন ঘটেছিল পিতার সাহিত্যপ্রীতির দৌলতে। আর মা আনোয়ারা বেগম (বিবাহপূর্ব নাম— মরিয়ম বেগম) তো রীতিমতো লেখিকা ছিলেন।4 মায়ের কাছেই সিরাজের শ্রুতিপাঠ শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই শিশু বয়সেই। তাই খুব কম বয়সেই সিরাজ তাঁর লেখার প্রেরণা পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন।
নয় কিংবা দশ বছর বয়সেই লিখেছিলেন ‘খোসবাশপুরের গুপ্তকথা’, নিজের চোখে দেখা চরিত্রকে কেন্দ্র করে-
আমার সজ্ঞানে পড়া প্রথম উপন্যাসঃ অনন্তপুরের গুপ্তকথা । তখন বয়স নয় কিংবা দশ। পড়েই লিখে ফেললাম খোশবাসপুরের গুপ্তকথা । মূল চরিত্র উচ্ছৃঙ্খল জমিদার এবং তার দুষ্ট সহকারী—আবার কে ? আমাদের পাড়ার সেই জামির সেখ।5
এইসময়েই সিরাজের মায়ের মৃত্যু হয় কিন্তু প্রকৃতির কোলে যে আশ্রয় পেয়েছে তাকে এ মৃত্যু ছঁতেই পারেনা পারেও নি। মাসি একলিমা বেগম মা হয়ে আসেন, যিনিও ছিলেন সাহিত্য অনুরাগিণী। প্রাথমিক পড়াশোনার সূত্রপাত পাশের গ্রাম গোকর্ণের কার্তিকডাঙা প্রাইমারি স্কুলে, তারপর গোকর্ণ প্রসন্নময়ী হাইস্কুলে। কিন্তু প্রকৃতির দুর্নিবার আকর্ষণ সিরাজকে ক্লাস ফাঁকি দিতে বাধ্য করতো। এই বয়সেই সিরাজ হিজল অঞ্চলের হিংস্র জনজীবন প্রত্যক্ষ করেছিল —
বড়বেড়েদের একটি ছেলে রহিম স্কুলে পড়েছিল।…. সে ছিল আমার বন্ধু। তার সঙ্গে হিজলে যেতাম।….[তাদের] বহিরাগতদের প্রতি অবিশ্বাস ও বিস্ময়, হিংসাপ্রবণতা, আবার চরম আনুগত্যবোধ, প্রেমবাৎসল্য ও অন্যান্য ধরণের মানবিক মূল্যবোধ—সবকিছু নিয়ে সে এক বিচিত্র জীবন।6
— এই কারণেই পিতা নিজের কর্মস্থল বর্ধমানের কালনায় নিয়ে যান এবং গোপালপুর মুক্তকেশী হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এখানকার একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। এখানেই সিরাজ এক সাঁওতাল সহপাঠী-বন্ধু কালিয়ার (কালীপ্রসাদ বেসরা) কাছ থেকে বাঁশি বাজাতে শিখেছিলেন, যে বাঁশি সিরাজের বহুদিনের সঙ্গী ছিল।
ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর ১৯৪৬-এ বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে আই এ তে ভর্তি হলেন, যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পরিচালিত ছাত্রসংগঠনে। কিন্তু বন্ধু ত্রিপুরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (যিনি মাইকেল ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন) হস্তক্ষেপে সিরাজের রাজনীতিক আর হয়ে ওঠা হলো না; কবিতা লিখতে শুরু করলেন। মুস্তাফা সিরাজের কবিতা লেখার সূচনা কিন্তু এইসময়ে শুরু হয়নি, হয়েছিল স্কুলজীবনে।7 যাইহোক তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়ে বের হলো মৌলানা আক্রাম খাঁ সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা মোহাম্মদী-তে। কিন্তু প্রখর আত্ম-সচেতন সিরাজ যখন জানতে পারলেন যে ঐ পত্রিকাটি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য তখনই কবিতা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু জাত-বোহেমিয়ান সিরাজ কলেজেও থিতু হতে পারেননি, চাকরি নিয়ে চলে যান খুলনার মোরেলগঞ্জে আর তার কিছুদিন পর মেদিনীপুরের পানিপারুলে। এই পানিপারুলেই তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বন্দর’ (অসম্পূর্ণ, অমূদ্রিত) লিখেছিলেন-
পানিপারুলে থাকাকালীনই ‘বন্দর’ নামে তিনি একটা উপন্যাস লিখতে থাকেন।8
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কবি হতে চেয়েছিলেন, তাই কবিতার ফাইল হাতে কলকাতায় নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতা সিরাজকে গ্রহণ করেনি। স্মৃতিতে জানান—
…সে এক অমানুষিক লাঞ্ছনা ঘটাল কলকাতা। লাথি মেরে ফেলে দিল।……কলকাতা হা হা করে হেসেছে এক নির্বোধ গ্রাম্য তরুনের কান্ড দেখে।9
কলকাতায় সিরাজ আট মাস কাটিয়েছিলেন। এই সময়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো বিখ্যাত দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুবের সংস্পর্শে আসা। দার্শনিকতার প্রথম পাঠ আইয়ুবের কাছ থেকেই তিনি পান। কলকাতার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সহ-সম্পাদক থাকাকালীন গুরু আইয়ুবের একটি প্রবন্ধের ( Dialectics of Atlantic pact ) প্রতিবাদ স্বরূপ একটি প্রবন্ধ লিখে গুরুর বিরক্তি উৎপাদন করেছিলেন। কবি বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকেই সিরাজ জেনে গিয়েছিলেন কবিতা তাঁর ভাষা নয়। আসলে বিষ্ণু দে’র খুব ভক্ত ছিলেন মুস্তাফা সিরাজ। বোধহয় এইসময়ই ‘দেশ’ পত্রিকায় সিরাজের ‘আমার বাউল বন্ধুরা’ শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।10 আর সেপ্টেম্বর, ১৯৫০-এ শেষ অভিসার 11 কবিতা। এই কবিতায় আছে কবির স্ব-অভিমানের পাশাপাশি এক বুকভরা বেদনার প্রকাশ–
আহা, তারো সাধ ছিল এ মাটির গান রচনার
তাঁর সে কামনা
আমার পাহাড়ে এসে প্রত্যাঘাতে জীর্ন হয়ে গেছে
সে সবার শেষে এসে
আঁধারের পাথুরে দেয়ালেরেখে গেল
বেদনার ম্লান ইস্তাহার12
শেষ পর্যন্ত সিরাজকে ‘‘একটা বাঁশের বাঁশি ফিরিয়ে নিয়ে গেল গ্রামীণ মিথের সুপরিচিত জগতে।’’ শুরু হল এক বিচিত্র-বিস্ময়কর জীবন। ‘আলকাপে’র দলে যোগ দিয়ে বহু বিনিদ্র যামিনী কাটিয়েছিলেন রাঢ় বাংলার গ্রামে-প্রান্তরে। সেই শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চকর জীবনের পরিচয় দেওয়ার আগে তাঁর আর একটি প্রতিভার দিক উন্মোচন করা যায়। পাশের গ্রাম গোকর্ণের শ্রদ্ধানন্দ স্মৃতিমন্দির পাঠাগারের উদ্যোগে সিরাজ ‘অঙ্কুর’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করেছিলেন, সাহায্য করেছিলেন পিতৃবন্ধু জগবন্ধু দাশ। সিরাজ নিজেই এই পত্রিকায় ছবি আঁকতেন লিখতেন। একবার ‘নিখিল ভারত পাণ্ডুলিপি’ প্রতিযোগিতায় ‘অঙ্কুর’ পুরস্কার পেয়েছিল।
কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরে ‘আলকাপ’ লোকনাট্যে যোগ দিলেন। কিন্তু কীভাবে ঘটলো এ সংযোগ? আসলে পারিবারিক সূত্রেই সিরাজ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন; কিন্তু ১৯৫০-এর দিকে যখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হল তখন Indian Peoples’ Theatre Association-এ যোগ দিলেন। IPTA-এর মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক সুধীন সেনের নির্দেশেই আলকাপে এলেন। খোশবাসপুরেই ১৬/১৭ জন তরুণকে নিয়ে গড়ে তুললেন “খোশবাসপুর আলকাপ দল।”13 সিরাজের স্মৃতিতে এইসময়ের কথা যেভাবে পাই—
কাটতে থাকল দিনরাত্রি গাঁয়েগঞ্জে হাটে বাজারে মেলায়-মেলায়। অজস্র মানুষ দেখলাম –বিচিত্র বিস্ময়কর সব চরিত্র। মুর্শিদাবাদ বীরভূম মালদা সাঁওতাল পরগণা দুমকা ঘুরেবেড়াই আলকাপ দলে। আড়াই হাজার রাত—ষাট হাজার ঘণ্টা কেটে যায় সৌন্দর্য ও যন্ত্রণার মধ্যে।14
কিংবা,
ছ-সাত বছর সে এক আশ্চর্য জীবন। সৌন্দর্য ও পাপ, অমৃত ও বিষ নির্দ্বিধায় পান করতে থাকলাম।15
কেননা সিরাজ তখন ‘সিরাজ ওস্তাদ’, ‘সিরাজ মাস্টার’; আলকাপের আসরে তখন ধ্বনিত হতো—
জয় জয় মা বাকবাদিনী কি জয় জয় জয় ওস্তাদ তানসেন কি জয় জয় জয় ওস্তাদ সিরাজ কি জয়।।
পরবর্তীকালে তাঁর ‘মায়ামৃদঙ্গ’(১৯৭২) উপন্যাসে এই আলকাপের ‘মায়া’র বিবরণ রয়েছে। এই মায়ার স্মৃতিতে লিখেওছিলেন একটি কবিতা ‘এখনো ভাবতে অবাক লাগে’।16 তাঁর কিছু অংশবিশেষ –
এখনও ভাবতে অবাক লাগে রমণীদের অপভ্রংশ
অর্ধ নারীশ্বরের পাশে রাত্রি যাপন পণ্ডশ্রম স্বপ্নসম।17
কী এই আলকাপ, যার মায়ার প্রেমে পড়েছিলেন লেখক ? আলকাপের উদ্ভবই বা ঘটেছিল কীভাবে ? আলকাপ হলো একধরণের লোকনাট্যরীতি। থার্ড থিয়েটার-এর সঙ্গে এর অনেকটাই মিল রয়েছে। আর এর উদ্ভব সম্পর্কে গবেষক সিরাজ বলেন,
উৎসমুখ যদি কোথাও থাকে, তা চৈত্র সংক্রান্তির গাজন অনুষ্ঠান – যার দেবতা শিব….. আদি আলকাপেরই একটি শাখা গম্ভীরা।18
যাইহোক আলকাপের মায়াও সিরাজকে ধরে রাখতে পারলো না। কলকাতার মায়া তখনো সিরাজের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। আলকাপের আসরেই কখনো কখনো অন্যমনস্ক হয়ে উঠে পড়তেন ; ভাবতেন তার তো সাহিত্যিক হবার কথা ছিল। তাই দীর্ঘ ছয় বছর পর ক্লান্তিতে আলকাপ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেন। এর মাঝেই গ্রামেরই এক ষোড়শী কন্যা হাসনে আরার প্রতি সিরাজের অনুরাগ জন্মেছিল। স্বাভাবিক জীবনে ফিরেই সিরাজ বিবাহ করলেন। এক দীর্ঘ সময়ের প্রাথমিক পর্বের যবনিকাপাত ঘটলো।
খ.
এই দ্বিতীয় পর্বের সূচনা বছরটি দুটি ক্ষেত্রে সিরাজের জীবনে স্মরণীয়। প্রথমত, পূর্ব-পরিণয়বশতঃ শ্রীমতী হাসনে আরাকে বিবাহ এবং দ্বিতীয়ত, কবিতা ছেড়ে গল্প লিখতে শুরু করা। সাহিত্যিক সিরাজের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা যে কতখানি তা সিরাজের স্বীকারোক্তিতেই প্রমাণ মেলে।19 স্ত্রীর সনির্বন্ধ অনুরোধেই সিরাজ গল্প লিখতে শুরু করলেন। স্ত্রীর উৎসাহ তাঁকে গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল –
আমি বললাম, ‘তুমি সাহিত্যিক হবে, তাহলে গান-থিয়েটার ছেড়ে লেখায় মন দাও। গল্প লেখ, ছোটগল্প। তোমার লেখার অসুবিধে যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা আমি করবো। তুমি শুধু লিখবে।’ সে বাধ্য ছেলের মতো আমার কথা শুনত।20
শুরু হলো সিরাজের গল্প লেখা। এইসময় তিনি একটি সমবায় সমিতির (কো-অপারেটিভ সোসাইটি) ম্যানেজার হিসাবে মহালন্দী কলোনিতে পোস্টিং ছিলেন। গল্পকার হিসাবে তাঁর আবির্ভাব বহরমপুরের মাসিক ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায়। পত্রিকাটি পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির মুখপত্র। ঐ পত্রিকায় ‘ইবলিশ’ ছদ্মনামে তাঁর প্রথম গল্প ‘কাঁচি’ প্রকাশিত হলো ১৯৫৮ তে। ছদ্মনামে লিখতেন বলে অনেকে তাঁকে স্বনামে লেখার কথা বলতেন। যাইহোক সিরাজের গল্প শহরের লোক নির্দ্বিধায় গ্রহণ করলো। ছদ্মনামে লেখার ব্যাপারে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এইরকম –
ইবলিশ মানে শয়তান। যে সবচেয়ে জ্ঞানী। মাটিতে চলাফেরা করা মানুষকে সে সেলাম করবে না। নত হবে না। মনের ভিতর এরকম একটা ভাব আনার চেষ্টা করছিলাম।21
এরপর সিরাজ লিখে চললেন একের পর এক ছোটগল্প ঐ ইবলিশ ছদ্মনামেই। প্রকাশিত হতো মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘একটি রক্তগোলাপের গল্প’22 ১৯৫৯-এ। ষাটের দশক বাংলা সাহিত্য জগতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ— এই সময়ের ‘হাংরি-শ্রুতি আন্দোলন’ কিংবা বিমল করের ‘এইদশক’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ছোটগল্পের নতুনরীতি বিষয়ক আন্দোলন কোলকাতার সাহিত্যিক-পাঠককুল উভয়কেই সমানভাবে আলোড়িত করে। অথচ গ্রামে বসেই লিখে ফেললেন ‘তরঙ্গিণীর চোখ’23 —লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক গল্প। গল্পের বিষয়, প্রকাশভঙ্গি সর্বাংশে নতুন ও আধুনিক। গল্পের বিষয়বস্তু এইরকম – গ্রামের মুচি-বায়েনরা এলাকার ভাগাড়ের ডাক নেয় আর ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া গোরু-মোষের চামড়া ছাড়িয়ে নেয় সঙ্গে কিছু মাংসও পায়। এক গ্রীষ্মের দুপুরে ভাগাড়ে দাঁড়িয়ে মুচি-বায়েনদের এক মেয়ে কঞ্চি দিয়ে শকুন তাড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে ‘বাবা! বাবা!’ বলে। আর আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে শকুন। এই সামান্য বিষয় আসামান্য রূপে গল্পে প্রতিভাসিত। স্পষ্টত এরপর কোলকাতা সিরাজকে গ্রহণ করলো। গল্পটি খুব জনপ্রিয় হয় এবং হিন্দিতে অনূদিতও হয় বিখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক কমলেশ্বর সম্পাদিত ‘শারিকা’ পত্রিকায়। অনুবাদ করেন প্রবোধ মজুমদার। এইসময়ের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কয়েকটি ছোটগল্পের তালিকা24 দেওয়া হলো–
| গল্প | পত্রিকার নাম | বিশেষ দিক |
| কাঁচি (১৯৫৮), কুতুবপুরের প্রেতিনী, মিঞাপণ্ডিত | সুপ্রভাত (বহরমপুর), সম্পাদক – প্রশান্ত বসু,একটি দ্বিমাসিক পত্রিকা | ইবলিশ’ ছদ্মনামে। ‘কাঁচি’ প্রথম প্রকাশিত গল্প |
| ভূচর (দ্বিতীয় গল্প) | কালান্তর (ঐ) | ইবলিশ ছদ্মনামে |
| হিজলের ডাক পুরুষ | বীথিকা (ঐ) | ঐ |
| হিজলবিলের গর্ভিনীরা | সংকেত (ঐ)সম্পাদক – অমলেন্দু সরকার ও হরিশঙ্কর দত্ত | ঐ , ত্রৈমাসিক পত্রিকা, এই পত্রিকায় ‘তিরিশ বছর বয়স’- নামে একটি কবিতাও প্রকাশ পেয়েছিল। |
| একটি রক্তগোলাপের গল্প (১৯৫৯) | স্বাধীনতা (দৈনিক) | স্বনামে পত্রিকার রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত |
| হিজলকন্যা, হিজলবিলের রাখালেরা (১৯৬০) | বিংশ শতাব্দী | — |
| তরঙ্গিণীর চোখ(জুন, ১৯৬২) | ছোটগল্প (সম্পাঃ লালমোহন দাস) | — |
| ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু (১৯৬২) | ঐ | শারদীয় সংখ্যা |
| ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন | দেশ (শারদীয়) | ১৯৬২ সাল। দেশ-এ প্রকাশিত প্রথম গল্প |
| বাবলতলির মাঠ পেরিয়ে, একটি সোনালি শামুক | পরিচয় | — |
| সীমান্ত থেকে ফেরা (১৯৬২) | অমৃত (সাপ্তাহিক) | চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে |
| অগ্নিবলয় | চতুষ্কোণ | ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে রচিত |
–তালিকায় উল্লিখিত গল্পগুলির প্রত্যেকটিই সিরাজ গ্রামে বসে লেখেন। কোলকাতায় তখনো তিনি আসেননি। উপন্যাসও লেখার সূত্রপাত তাঁর স্ত্রীর উৎসাহেই। বিয়ের পর নিজে যে সাহিত্যিক তা প্রমাণ দিতে গিয়ে দু’বছর ধরে একটি উপন্যাস লিখলেন, যা পরবর্তী কালে ১৯৬৯-এ ‘কথাশিল্পী’ থেকে ‘কিংবদন্তীর নায়ক’ নামে প্রকাশিত হয় ; যদিও প্রথমে এর নাম ভাবা হয়েছিলো ‘চণ্ডালিকার চণ্ডাল’ বা ‘চণ্ডালের মাঠ’।25 রাঢ়-বাংলার গ্রামাঞ্চলের ‘জাগাল’-দের ভালবাসা-সুখ-দুঃখকে প্রকট করে তুলেছেন এই উপন্যাসে, সেই সঙ্গে তারাশঙ্করের মতো আঞ্চলিকতার সোঁদা গন্ধ। তবে ‘অয়ন’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘নীলঘরের নটী’ (১৯৬৬) উপন্যাসখানিই লেখকের প্রথম গ্রন্থিত উপন্যাস। আলকাপের দলের স্মৃতি-বিজড়িত কাহিনী উপন্যাসটির মূল বিষয়।
পাঁচের দশকে লেখার সূচনা, যদিও ষাটের দশক থেকে তাঁর লেখা পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দেয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে ষাট-সত্তর দশকের কথাকার হিসাবে চিহ্নিত করা হয় কারণ তাঁর কথনবিশ্বের মূল কাঠামোটি এই পর্বেই নির্মিত হয়।
সূত্রনির্দেশ
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখকের আত্মকথা, (তরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’ করুণা প্রকাশনী, ২০১৩ গ্রন্থে পুনর্মূদ্রিত)। পৃ. ১০১
- সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় কর্তৃক গৃহীত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাক্ষাৎকার, বইয়ের দেশ, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১১। পৃ. ১৩৪
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখকের আত্মকথা, (তরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’ করুণা প্রকাশনী, ২০১৩ গ্রন্থে পুনর্মূদ্রিত)। । পৃ. ৯৭
- “মা আনোয়ারা বেগম কবিতা ও গল্প লিখতেন। বিচিত্রা, বঙ্গলক্ষ্মী, সওগাত, গুলিস্তাঁ ইত্যাদি সে সময়কার কলকাতার অজস্র পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরুত।”— প্রাগুক্ত। পৃ. ৯৭ [উল্লেখ্য মায়ের প্রকৃত নাম ছিল মরিয়ম বেগম]
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখকের আত্মকথা, (তরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’ করুণা প্রকাশনী, ২০১৩ গ্রন্থে পুনর্মূদ্রিত)। পৃ. ৯৯
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখকের আত্মকথা, (তরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’ করুণা প্রকাশনী, ২০১৩ গ্রন্থে পুনর্মূদ্রিত)। । পৃ. ৯২
- “ক্লাস সেভেনে গোকর্ণ স্কুলের পাঠাগার থেকে গীতাঞ্জলি নিয়ে আসি একদিন। পরদিন বিকেলেই বাবার বাক্সো থেকে পুরনো একপাতা ছাপা রাজনৈতিক ইস্তাহার চুরি করে খাতা তৈরি করি এবং নাম দিই ‘কাব্যক্রীড়া’। গীতাঞ্জলির ঢঙে এক দুই করে নামহীন পদ্যে ভরে তুলি পাতা।”— প্রাগুক্ত। পৃ. ৯৯
- সৈয়দ খালেদ নৌমান, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজঃ জীবন ও সাহিত্য প্রবন্ধ, তরুন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজঃ স্মরণে চিন্তনে’, মেইনস্ট্রীম পাবলিকেশন, ১৪২২ বঙ্গাব্দ, কলকাতা। পৃ. ১৮
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখকের আত্মকথা, (তরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’ করুণা প্রকাশনী, ২০১৩ গ্রন্থে পুনর্মূদ্রিত)। পৃ. ১০০
- প্রাগুক্ত। পৃ. ১০৪
- ‘রচনাকাল ১৯৫০। ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০-এর দেশ-এ প্রকাশিত।’ – নাজিমুল ইসলাম মন্ডল সম্পাদিত সমকালের জিয়নকাঠি (সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সংখ্যা), জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে সংগৃহীত।
- ‘শেষ অভিসার’ কবিতা।
- সৈয়দ খালেদ নৌমান, প্রাগুক্ত। পৃ. ২০
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখকের আত্মকথা, (তরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’ করুণা প্রকাশনী, ২০১৩ গ্রন্থে পুনর্মূদ্রিত)। পৃ. ১০১
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, লেখকের আত্মকথা, (তরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’ করুণা প্রকাশনী, ২০১৩ গ্রন্থে পুনর্মূদ্রিত)। পৃ. ১০০
- রচনাকাল- ১৯৬৪। ‘কখনও কবিতা’ শীর্ষক সংকলনে ১৯৮০-তে প্রকাশিত। সমকালের জিয়নকাঠি , ঐ থেকে সংগৃহীত।
- এই কবিতাটি ‘আলকাপ’-এর স্মৃতিতে লেখা।
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আলকাপ নাট্যরীতি ও থার্ড থিয়েটার, মুসলিম চিত্রকলার আদিপর্ব এবং অন্যান্য, মিত্র ও ঘোষ, ১৪০০ বঙ্গাব্দ, কলকাতা। পৃ. ৪৮
- সাহিত্য আকাদেমি প্রযোজিত The Unreal Man real Artist (2012, directed by K.C. Das) — এ সিরাজের সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য।
- হাসনে আরা সিরাজ, সে ছিল এক মহান মানুষ, সমকালের জিয়নকাঠি (সম্পা. নাজিমুল ইসলাম মন্ডল ), সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৩। পৃ. ৬২
- সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় কর্তৃক গৃহীত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাক্ষাৎকার, বইয়ের দেশ, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১১। পৃ. ১২২
- ১৯৫৯ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার রবিবাসরীয় পাতায় প্রকাশিত। দ্রষ্টব্য – ‘সৈয়দ খালেদ নৌমান, ঐ । পৃ. ২৫
- লালমোহন দাস সম্পাদিত ছোটগল্প পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই গল্প লিখে তিনি প্রথম ১০ টাকা রোজগার করেছিলেন।
- তালিকাটির তথ্য তৈরিতে ‘সৈয়দ খালেদ নৌমান, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজঃ জীবন ও সাহিত্য প্রবন্ধ, ঐ । থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
- সৈয়দ খালেদ নৌমান লিখিত প্রাগুক্ত প্রবন্ধে (পৃ. ২৫) উল্লেখিত হয়েছে চণ্ডালিকার চণ্ডাল । এবং জমিল সৈয়দ, সংসারে এক সম্রাট, সমকালের জিয়নকাঠি, ঐ। পৃ. ৭০ – এ উল্লিখিত হয়েছে চণ্ডালের মাঠ ।